নিজস্ব প্রতিনিধি:
কুমিল্লায় ২৯ টি চোরাই গাড়িসহ সঙ্ঘবদ্ধ গাড়িচোর চক্রের ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১১ সিপিসি-২।
সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লাসহ সারাদেশে গাড়ি চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে খুন, অর্থ দাবী, মারাতœকভাবে আহত সহ বিভিন্ন মর্মান্তিক ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। বিগত কয়েক মাসে অসংখ্য গাড়ি চুরির অভিযোগ র্যাব-১১, সিপিসি-২ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর দায়েরকৃত সাধারণ ডায়েরী ও লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব-১১, সিপিসি-২ মাঠ পর্যায়ে ছায়া তদন্ত শুরু করে ও গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করে। গোয়েন্দা তৎপরতা হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী কুমিল্লা জেলার বেশ কয়েকটি স্পট ও গ্যারেজ গাড়ি চুরির পয়েন্ট হিসেবে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। এছাড়া ছায়াতদন্ত থেকে গাড়ি চোর চক্রের কয়েকটি সিন্ডিকেটের সন্ধান পাওয়া যায়।
গত ১৮/০২/২০২৩ইং তারিখ রাতে পর্যবেক্ষণের আওতাধীন কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী মডেল থানাধীন পালপাড়া এলাকার খলিলের গ্যারেজে একটি চোরাই গাড়ি রয়েছে মর্মে তথ্য পাওয়া যায়। পুরো সিন্ডিকেটকে হাতে নাতে গ্রেফতারের নিমিত্তে উক্ত গ্যারেজটিকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হয় এবং পরবর্তীতে ১৯/০২/২০২৩ইং তারিখ রাতে সিন্ডিকেট এর সদস্যরা কাটার মেশিন দিয়ে একটি কাভার্ড ভ্যান কেটে যন্ত্রপাতি আলাদা করার সময় চক্রের মূলহোতা খলিল সহ ০৮ জন সদস্যকে হাতে নাতে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত আসামীরা হলোঃ ১। কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী মডেল থানার আড়াইওড়া গ্রামের মৃত মনোহর আলী এর ছেলে কাউসার আলী খলিল (৪৫); ২। একই গ্রামের ওহাব কাজী এর ছেলে মোঃ কাইয়ুম (৪২); ৩। মোঃ মুক্তার হোসেন মুসা এর ছেলে মোঃ সাজিদ হোসেন (২০); ৪। কুমিল্লা কোতয়ালী মডেল থানার বাটপাড়া গ্রামের নান্নু মিয়ার ছেলে নাজমুল হোসাইন রবিউল (১৯); ৫। একই থানার হাড়ং গ্রামের মোঃ আলম মিয়া এর ছেলে মোঃ আবু কাউসার (৩৫); ৬। একই থানার বদরপুর গ্রামের মোঃ হোসেন এর ছেলে মোঃ পিয়াস (৩৩); ৭। একই থানার আড়াইওড়া গ্রামের মৃত দিদার বক্স এর ছেলে মোঃ জহির মিয়া (৪০) এবং ৮। একই থানার মধ্যম মাঝিগাছা গ্রামের মোঃ হান্নান মিয়া এর ছেলে মোঃ জামশেদ হোসেন (২১)। গ্রেফতারকৃত আসামীদেরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ও তাদের নিকট হতে প্রাপ্ত মোবাইল ফোন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১৪/০২/২০২৩ইং তারিখে আলীম সরকার (৪৩), পিতা-লতিফ সরকার, সাং-বাগুর, থানা-দেবিদ্বার, জেলা-কুমিল্লা একটি কাভার্ড ভ্যান চুরি হওয়া মর্মে র্যাব-১১, সিপিসি-২ বরাবর যে অভিযোগ করেন উদ্ধারকৃত কাভার্ড ভ্যানটি তার চুরি হওয়া সেই কাভার্ড ভ্যান। এছাড়া তাদের স্বীকারোক্তিতে গাড়ি চুরির সাথে সম্পৃক্ত আরেকটি সিন্ডিকেটের বেশ কয়েকজন সদস্যের তথ্য পাওয়া যায়। পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃত আসামীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯/০২/২০২৩ রাতেই কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী মডেল থানাধীন চম্পকনগর, বুড়িচং থানাধীন ভারেল্লা (দক্ষিণ) ও পশ্চিম সিংহ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে উক্ত চক্রের মূলহোতা জাহাঙ্গীর সহ ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলোঃ ১। কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার থানার নবীয়াবাদ গ্রামের মৃত সামসুল আলম এর ছেলে মোঃ সাইফুল ইসলাম জাহাঙ্গীর (৪৫), ২। কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী মডেল থানার শিমরা গ্রামের আনোয়ার হোসেন এর ছেলে হৃদয় হাসান (১৯); ৩। কুমিল্লা জেলার বুড়িচং থানার কংশনগর গ্রামের ধনু মিয়া এর ছেলে শুক্কুর আলী (২৩); ৪। কুমিল্লা জেলার বুড়িচং থানার পারোয়ারা গ্রামের শাহ আলম এর ছেলে রিপন মিয়া @ আব্দুল আলীম (২৭); ৫। কুমিল্লা জেলার চান্দিনা থানার শ্রীমন্তপুর গ্রামের মোঃ মোহর আলী এর ছেলে মোঃ সাইফুল (৩২); ৬। কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া থানার শাহেরাবাদ গ্রামের মইনুল হোসেন এর ছেলে মোঃ আল আমিন (২৪); ৭। কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী মডেল থানার শাসনগাছা গ্রামের আব্দুল মালেক এর ছেলে মনির মিয়া (৩৯); ৮। কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী মডেল থানার আড়াইওড়া গ্রামের কাজী মঞ্জিল এর ছেলে মজিদ (৩০); ৯। কুমিল্লা জেলার বুড়িচং থানার পাঝয়ারা গ্রামের ধনু মিয়া এর ছেলে মোঃ তাজুল ইসলাম (৩২); এবং ১০। কুমিল্লা জেলার বুড়িচং থানার পশ্চিম সিংহ গ্রামের শাহজাহান এর ছেলে মোঃ ওমর ফারুক (২৮)। এছাড়াও উক্ত চক্রের অন্যান্য পলাতক আসামীরা হলোঃ ১। শফিক (৬০), পিতা- বসত আলী, সাং-হারং, থানা-চান্দিনা, জেলা-কুমিল্লা; ২। কামাল (৫২), পিতা- অজ্ঞাত, সাং-আড়াইওড়া, থানা-কোতয়ালী মডেল, জেলা-কুমিল্লা; ৩। জহিরুল (৩৬), পিতা- অজ্ঞাত, সাং-অজ্ঞাত, থানা- আখাউড়া, জেলা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া; ৪। সোহেল (৩০), পিতা- অজ্ঞাত, সাং-দেবপুর, থানা- বুড়িচং, জেলা-কুমিল্লা; ৫। সেলিম (৩৫), সাং- আড়াইওড়া, থানা-কোতয়ালী মডেল, জেলা-কুমিল্লা; ৬। জালাল (৪৫), পিতা-মৃত সাত্তার, সাং-ভারেল্লা (দক্ষিণ), থানা-বুড়িচং, জেলা-কুমিল্লা; ৭। জামাল (৪৫), পিতা-আদু মিয়া, সাং-পশ্চিম সিংহ, থানা-বুড়িচং, জেলা-কুমিল্লা; ৮। মনির (৪০), পিতা- অজ্ঞাত, থানা- চান্দিনা, জেলা-কুমিল্লা; ৯। নজির (৩৬), পিতা- অজ্ঞাত, সাং-কাদুরি, থানা-চান্দিনা, জেলা-কুমিল্লা, ১০। মোঃ পাবেল আহম্মেদ (৩০), পিতা- শফিকুল ইসলাম, সাং- ভানাসোয়া, থানা- কোতয়ালী মডেল, জেলা- কুমিল্লা। গ্রেফতারকালে উক্ত চক্রের সদস্যদের নিকট হতে ০১ টি কাভার্ড ভ্যান, ০২ টি মোটরসাইকেল ও ২৬ টি ব্যাটারীচালিত গাড়িসহ অসংখ্য যন্ত্রাংশ উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। মূলত ০৩ টি গ্রুপের সমন্বয়ে তারা গাড়ি চুরি ও নতুন করে বাজারজাত করে। ১ম গ্রুপ (গ্রেফতারকৃত আসামী সাজিদ, জামশেদ, নাজমুল, মজিদ, ফারুক ও পলাতক আসামী মনির, সেলিম, সোহেল, কামাল) যাত্রীবেশে শহরের বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করে গাড়িগুলোকে টার্গেট করে এবং সুযোগ বুঝে ড্রাইভারকে জিম্মি করে বা ড্রাইভারের অনুপস্থিতে সেগুলো চুরি করে। এছাড়াও চুরিকৃত গাড়িগুলো যেন সহজে কেউ খুজে না পায় সেজন্য তারা এক এলাকা হতে গাড়িগুলো অন্য এলাকায় নিয়ে যায়। ২য় গ্রুপের (কাইয়ুম, পিয়াস, জহির, শুক্কুর ও পলাতক আসামী শফিক, জহিরুল, জালাল, জামাল, নজির) কাজ হলো চুরিকৃত গাড়িগুলো বিক্রির জন্য যে এলাকা থেকে গাড়িগুলো চুরি হয়েছে ঐ এলাকা ব্যতীত অন্য এলাকার গ্যারেজ মালিকদের নিকট গাড়িগুলো বিক্রি করা এবং তাদের নিকট পৌছে দেওয়া (যদি গাড়ি চান্দিনা থেকে চুরি করা হয় তাহলে তা ২য় গ্রুপের মাধ্যমে বুড়িচং অথবা কুমিল্লা শহরের গ্যারেজ মালিকের নিকট বিক্রি করা হয়)। মূলত চক্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে থাকে ৩য় গ্রুপের সদস্যরা। এই গ্রুপের সদস্যরা (খলিল, তাজুল, মনির, সাইফুল, জাহাঙ্গীর) ২য় গ্রুপের সদস্যদের নিকট হতে গাড়িগুলো স্বল্পমূল্যে ক্রয় করে তাদের নিজস্ব গ্যারেজে নিয়ে অতি দ্রুত গাড়িগুলোর ব্যাটারী ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ খুলে রং পরিবর্তন করে কয়েকটি গাড়ির যন্ত্রাংশ একত্রিত করার মাধ্যমে নতুন গাড়িতে পরিণত করে এবং নতুন গাড়ি হিসেবে গ্রাহকের নিকট বিক্রি করে। নতুন গাড়িটির সাথে চুরি হয়ে যাওয়া গাড়িটির কোন মিল খুজে পাওয়া যায় না বলে এই চক্রের সদস্যরা নির্ভয়ে এ্ই কাজ পরিচালনা করে আসছে। আসামীদের স্বীকারোক্তি মতে আরো জানা যায়, তারা প্রায় ১০ বছর যাবৎ এই ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত। মূলত ৩য় গ্রুপ ২য় গ্রুপের মাধ্যমে চুরিকৃত গাড়িগুলো প্রায় ৩০-৫০ হাজার টাকা মূল্যে ১ম গ্রুপের নিকট থেকে ক্রয় করে এবং ২য় গ্রুপের সদস্যদেরকে প্রতিটি গাড়ি বাবদ ৫-১০ হাজার টাকার সম্মানী পায়। ৩য় গ্রুপ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ পরিবর্তনের মাধ্যমে পুরাতন গাড়িকে নতুন গাড়িতে পরিণত করে প্রায় ৯০,০০০/- থেকে ১,০০,০০০/- টাকায় গ্রাহকের নিকট বিক্রি করে।
উক্ত বিষয়ে গ্রেফতারকৃত আসামী ১। খলিল, ২। কাইয়ুম, ৩। সাজিদ, ৪। নাজমুল, ৫। কাউসার, ৬। পিয়াস, ৭। জহির, ৮। জামসেদ ও পলাতক আসামী ১। মনির (৪০), ২। সেলিম (৩৫), ৩। সোহেল (৩০), ৪। কামাল (৫২)সহ অজ্ঞাতনামা আরো ২/৩ জনের বিরুদ্ধে কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী মডেল থানায় এবং গ্রেফতারকৃত আসামী ১। জাহাঙ্গীর, ২। শুক্কুর আলী, ৩। রিপন মিয়া, ৪। সাইফুল, ৫। আল আমিন, ৬। মনির, ৭। মজিদ, ৮। তাজুল ইসলাম, ৯। হৃদয় হাসান, ১০। ওমর ফারুক এবং পলাতক আসামী ১। শফিক, ২। জহিরুল, ৩। জালাল, ৪। জামাল ও ৫। নজির, ৬। মোঃ পাবেল সহ অজ্ঞাতনামা ২/৩ জনের বিরুদ্ধে কুমিল্লা জেলার বুড়িচং থানায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।
মন্তব্য করুন