ফোনে মাকে বলছিলেন রকি,আমারে বাঁচাও আগুন লাগছে
২৪ দিন আগে শনিবার, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪
মোবাইলফোনে মায়ের কাছে বাঁচার আকুতি জানিয়েছিলেন কামরুল হাবিব রকি (২১)। ফোনে চিৎকার করে বলছিলেন, ‘মা আমাদের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে আগুন লাগছে আমারে বাঁচাও। ’ কিন্তু, বাঁচতে পারলেন না।
বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে রাজধানীর বেইলি রোডস্থ ভবনে লাগা আগুনের ঘটনায় তিনি মারা যান। দরিদ্র পরিবারে শত স্বপ্ন আর হাসিমুখে দুই মাস আগে কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় চাকরি নেন রকি। এবার দুই মাস পর তিনি বাড়িতে ফিরলেন দগ্ধ পোড়া লাশ হয়ে। রকির বাড়ি যশোর সদর উপজেলার ধোপাখোলা গ্রামের কামারপাড়াতে।
শুক্রবার (১ মার্চ) বেলা ১১ টার দিকে তার লাশ পৌঁছায় গ্রামের বাড়িতে। তার মৃত্যুসংবাদে স্বজন, প্রতিবেশীরা ভিড় করে একনজর দেখতে। তাদের আহাজারি, কান্নায় গোটা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
দুপুরে নিহত রকির গিয়ে দেখা গেছে, দূরদূরান্ত থেকে আত্মীয়-স্বজনেরা রকির বাড়িতে ভিড় করছেন। বাড়ির উঠানে খাটিয়ায় কাফনে মোড়ানো রকির মরদেহ। তাকে ঘিরেই স্বজনেরা চেয়ারে বসে আছের।
একটু দূরেই চেয়ারে দাদি রেহেনা বেগম আহাজারি করছেন। তার একটু দূরেই রকির মা রিপা খাতুন বিলাপ করছেন। আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা তাকে ঘিরে রয়েছেন, সান্ত্বনা দিচ্ছেন তাকে।
এ সময় বিলাপ করে রিপা খাতুন বলতে লাগলেন, ‘আমার ছেলেটারে মাদরাসাতে পড়িয়েছি। নামাজ কালামের উপরেই থাকত। কত আদরের ছেলে ছিল। ও শোনা পাখি.....। তুমি (রকি) না বলেছিলে আমারে ছাড়া থাকতে পারবা না। কেন তুমি আমারে ছেড়ে চলে গেলে। আমারে খুব ভালোবাসতো রকি। আমি অসুস্থ হলে আমার সকল কাজে সহযোগিতা করতো।
আহাজারি করতে করতে তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমারে কল দিয়েছে ছেলে। দিয়ে বলছে, মা আমার কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে আগুন লেগেছে। আমারে বাঁচাও। আমিও তারে (রকি) সান্ত্বনা দিচ্ছি তোমার কিছু হবে না সোনা। দোয়া পড়ো সব ঠিক হয়ে যাবে। তার পরেও সে বলতো লাগলো, আম্মু আমি আর বাঁচবো না। তার পরে ফোন কেটে গেল আর কিছু শুনতে পারলাম না। আর কোনো কথাও হলো না। আমার সোনা আমারে না রেখে কিছু খেত না। এখন কি হবে সোনা। ও আল্লাহ তুমি আমার সোনারে ফিরিয়ে দাও...। আমার সোনার বদলে আমারে নিয়ে নাও....। ’
নিহত রকির ভাই কামরান হোসেন সাজিম বলেন, ‘আমার ভাই আলিম পাস করে গত ডিসেম্বর মাসে কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় ক্যাশিয়ার পদে চাকরি নেন। বৃহস্পতিবার রাদে সেখানে কর্মরত অবস্থায় আগুন লাগে। তিনি ভবনের ভেতরে আটকা পড়েন। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। আগুনের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়েই তার মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার সকালে তার মরদেহ বাড়িতে এসেছে।
কামরান হোসেন সাজিম আরও বলেন, ‘আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে রকি সবার বড়। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে চাকরি করে সংসারের হাল ধরেছিলেন। বাবা ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চালান। তাদের দুজনের আয়ে আমাদের সংসার চলত। ভাইকে এভাবে হারাতে হবে কখনো কল্পনাই করিনি। ’
নিহত রকির মামা জিহাদ হোসেন বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে রকির ম্যাসেঞ্জারে ভিডিও কল দিয়েছি, সে রিসিভ করেনি। পরে আমাকে কল ব্যাক করে বাঁচানোর আকুতি জানায়। আমাকে বলে মামা আমাদের ব্রাঞ্চে (কাচ্চিভাই বেইলি রোড শাখা) আগুন লাগছে। আমি আটকা পড়েছি। আমাকে বাঁচাও। কিছুক্ষণ পর কল কেটে যায়। আমি ৯৯৯ নম্বরে কল দিয়ে বিষয়টি জানাই। তারা জানায় উদ্ধার কাজ চলছে, ধৈর্য ধরুন। এরপর আমি ঢাকায় রওনা হই। সেখানে হাসপাতালে পাই রকিকে। ততক্ষণে তার মৃত্যু ঘোষণা করেছে ডাক্তাররা।
তিনি বলেন, আমিই রকিকে ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিলাম। ওর চাকরির পর আমিই ঢাকা চিনিয়েছি। গত ডিসেম্বরে রকি চাকরিতে ঢুকেছে। আজ ওর লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
এদিকে নিহত রকির বাড়িতে শোকের মাতম চলছে। স্বজনদের আহাজারিতে চারিপাশ ভারী হয়ে উঠেছে। প্রতিবেশীরাও রকিন স্মৃতিচারণ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। সবাই সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়েন। রকির মা রিপা বেগম ও বাবা কবির হোসেন সন্তানের শোক বাকরূদ্ধ হয়ে পড়েছেন। শুধু সন্তানের জন্য মাতম করছেন তারা। বাদ জুমা স্থানীয় মসজিদে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে রকিকে দাফন করা হয়েছে।